গণভোটে জনমতের প্রতিফলন কতটা ঘটে? কেমন ছিল অতীতের গণভোট

বিবিসি বাংলা:
বাংলাদেশে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নেওয়ার জন্য একটি গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হওয়ার কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

গত কয়েকমাস ধরে আলোচনার পর দলগুলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের বিষয়ে একমত হলেও শেষ পর্যন্ত সেটি কতটা জনমতের প্রতিফলন ঘটাতে পারবে- এ নিয়েও নানা প্রশ্ন ও আলোচনা আছে।

কেননা অভিযোগ আছে, দেশের প্রথম দুটি গণভোটে শুধুমাত্র ‘ব্যালটে সিল দিয়ে ব্যালট বাক্সে ভরা হয়েছিলো’ সামরিক শাসকদের বৈধতা দেয়ার জন্য।

আর তৃতীয় গণভোটের বিষয়বস্তু ছিলো সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য। সব দল তাতে আগেই একমত হওয়ায় ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরের সেই গণভোট খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে গণভোট হয়েছে বা নেয়ার চর্চা আছে। তবে বাংলাদেশে যেগুলো হয়েছে তাতে জনগণ ভোট দিতে পেরেছে কতটা- তা নিয়েই প্রশ্ন আছে।

তাদের মতে, এবার ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন জনগণ চায় কি-না তা যাচাইয়ের জন্য যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো গণভোট চাইছে অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনের সাথে একই দিনে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গণভোট হলে তাতে জনমতের প্রতিফলন পাওয়া যেতে পারে।

যদিও প্রস্তাবিত গণভোট কবে কখন হবে সেগুলো নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য হয়নি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য আশা প্রকাশ করেছে যে, বুধবার কমিশনের সাথে দলগুলোর বৈঠকে এ নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আশা সম্ভব হবে।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে পেতে গত ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলো ঐকমত্য কমিশন। রবিবার কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাঁদের সম্মতির জন্য গণভোটের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে।

যদিও আওয়ামী লীগ আমলে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিলো।

আবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় আদালত আবার গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।

কিন্তু এটি কোন প্রক্রিয়ায় এটি বাস্তবায়ন হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।

আগের তিন গণভোট কেমন ছিলো

বাংলাদেশে মোট যে তিনটি গণভোট হয়েছে তার প্রথম দুটিকে বলা হয় প্রশাসনিক গণভোট আর তৃতীয়টিকে বলা হয় সাংবিধানিক গণভোট।

এর কারণ হলও প্রথম দুটিতে দেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ হ্যাঁ-না ভোট করে নিজেদের শাসন কাজের বৈধতা নিয়েছেন।

তখনকার ফলাফল অনুযায়ী ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের পক্ষে হ্যাঁ-তে ভোট পড়েছিলো ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। এর আগে ওই বছরের এপ্রিলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন তিনি।

আর ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় প্রশাসনিক গণভোটে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পক্ষে হ্যাঁ ভোট পড়েছিলো ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ নির্বাচনে বিষয়বস্তু ছিলো – এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কি-না।

সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলছেন, ওই দুটি নির্বাচনে জনগণ আসলে ভোটে অংশ নেয়ারই সুযোগ পায়নি।

‘প্রথম দুটি গণভোটেই আর্মির লোকজন বা তাদের সমর্থকরা সিল মেরে বাক্স ভর্তি করেছে। ওগুলো কোনো নির্বাচনই ছিলো না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোটের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলছেন, বাংলাদেশের গণভোটের ঐতিহ্য খুবই খারাপ।

‘মূলত জনগণের সম্মতি ছাড়া যারা ক্ষমতা দখল করেছিলো, তারা নিজেদের বৈধতা দিতে গণভোট প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছে তখন,’ বলছিলেন তিনি।

তবে ১৯৯১ সালের তৃতীয় গণভোট- যেটি সাংবিধানিক গণভোট হিসেবে পরিচিত, তা খুব একটা আলোচনায় আসেনি। কারণ গণভোটটি হয়েছিলো দ্বাদশ সংশোধনী বিল- যার ভিত্তিতে দেশ রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরেছে, তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেয়া উচিত কি-না তা নিয়ে।

এই নির্বাচনেও ৮৪ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে রেকর্ড আছে। ভোটের এই পরিসংখ্যান নিয়ে তখনই নানা অভিযোগ উঠেছিলো।

কিন্তু তা খুব একটা আলোচনায় আসেনি কারণ সব দল তখন আগেই সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিলো, বলছিলেন নিজাম উদ্দিন আহমদ।

হাসনাত কাইয়ুমের মতে, এই গণভোটটা আসলে সেভাবে জনমনে স্বীকৃতিই পায়নি কারণ এর কার্যত কোনো গুরুত্বই ছিলো না।

তবে তারা দুজনই বলেছেন, গণভোটে জনমতের প্রতিফলন আগে না এলেও সামনে কেমন হবে, তা নির্ভর করবে ভোটটি কখন কার অধীনে কোন বিষয় নিয়ে হবে- তার ওপর।

কীভাবে হবে গণভোট, দলগুলো কী বলেছে

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ রোববার বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকের পর বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়েছে।

‘জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে,’ সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেছেন তিনি।

কমিশনের সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যদি জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করা হয় তাহলে সংবিধান আদেশ বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যাতে ম্যান্ডেটের অভাব না হয়, জনগণ এটা সমর্থন করে কি না, সে অনুমতির জন্য গণভোট হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিনই আলাদা ব্যালটে জনগণের মত নেওয়া যায়। তাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করা বাধ্যতামূলক হবে এবং কেউ আর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,’ সভার পর ব্রিফিংয়ে বলেছেন তিনি।

সোমবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় তিনি একটি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলছে তারা সংসদ নির্বাচনের আগেই এই গণভোটের পক্ষে।

‘জুলাই সনদ জনগণ অনুমোদন করে কি না, এটা নিয়ে হবে গণভোট। এটা হলে জুলাই সনদের শক্তিশালী আইনি ভিত্তি হবে। আগে গণভোট হয়ে যাক,’ ব্রিফিংয়ে বলেছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।

নবগঠিত দল এনসিপি অবশ্য কমিশনের সভায় গণভোটের আগে জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রস্তাব দিয়েছে।

আলী রীয়াজ অবশ্য আশা করেছেন, বুধবারই এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়ে যাবে। আর যদি ঐকমত্য না হয় তাহলে তারা একাধিক পদ্ধতির সুপারিশ করবেন বলেও জানিয়েছেন।

তবে এবারেও যারা গণভোট চাইছে, তারা সবাই ‘জুলাই সনদের’ পক্ষে শক্তি। আবার সরকারও চাইছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হোক। ফলে গণভোট যখনই হোক তা কেমন হয় সেদিকে অনেকের দৃষ্টি থাকবে বলে বলছেন বিশ্লেষকরা।

‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গণভোট অধিকতর নিরাপদ হওয়ার সুযোগ থাকবে,’ বলছিলেন অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ।

হাসনাত কাইয়ুম বলছেন , এবারের গণভোট সরকার বৈধতা দেওয়া বা সরকার গঠনের জন্য হবে না। এটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকারকে বাধ্য করার জন্য। তাই এর গুরুত্ব আলাদা। সে কারণে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ এবার হয়তো থাকবে না।

Related posts